শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৩ অপরাহ্ন
কলাপাড়া প্রতিনিধি॥ কৃষি খাতের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষকের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারের শতকরা ৪ টাকা সুদের ঋন বিতরনে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় সীমহিীন অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা কৃষি বিভাগের সাথে তফসিলী ব্যাংক গুলোর সমন্বয়হীনতা, কৃষি ঋন বিতরনে বেসরকারী ব্যাংক গুলোর অনাগ্রহ, প্রকৃত কৃষকের ঋন পেতে হয়রানী, ব্যাংকে দালাল প্রবনতা, কৃষি বিভাগের যথাযথ তদারকির অভাব, জনগুরুত্বপূর্ন স্থানে কৃষি প্রনোদনার ঋন বিতরনের ব্যানার না টানানো, কৃষি কর্মকর্তার প্রত্যয়ন ছাড়াই ঋন বিতরন কৃষি প্রনোদনার এ ঋন বিতরনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
এছাড়া তফসিলী বেসরকারী ব্যাংক গুলো উপকূলীয় এলাকার কৃষি উৎপাদনকে সচল রাখতে কোন কৃষককে এ পর্যন্ত শতকরা ৪টা সুদের বিশেষ প্রনোদনার এ ঋন বিতরন করেনি। এনিয়ে তাদের কোন জবাবদিহিতাও নেই। এমনকি রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংক গুলো দালাল নির্ভর হয়ে কৃষি বিভাগের প্রত্যয়ন ছাড়াই লক্ষ লক্ষ টাকা বিতরন করছে। এতে প্রকৃত কৃষকরা সরকারের এ সুবিধা থেকে অনেকটা বঞ্চিত হওয়ার উপক্রম হয়েছেন। এমনকি গত কয়েক বছরে কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় গঠিত উপজেলা কৃষি কমিটির সভা কাগজে কলমে অনুষ্ঠিত হলেও বাস্তবে কোন সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। এছাড়া কৃষিকে সচল রাখতে পানি ওঠা নামার অন্তত: ৩০০ স্লুইস কৃষকের স্বার্থ ভুলুন্ঠিত করে প্রভাবশালীদের মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত হওয়ায় কৃষি ব্যবস্থা হুমকীর মুখে পড়েছে। -তথ্য নির্ভরযোগ্য সূত্রের।
রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, নভেল করোনা ভাইরাস এর প্রাদুর্ভাবে কৃষি খাতের জন্য ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার প্রনোদনার আওতায় শষ্য ঋন ব্যতীত কৃষির অন্যান্য খাতে বিতরনের জন্য বরিশাল বিভাগে ১১৯৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এতে শষ্য ও ফসল খাতে শতকরা ৪ টাকা রেয়াতি সুদ হারে কৃষকের মাঝে ঋন বিতরনের জন্য বলা হয়েছে। যার মেয়াদ ১এপ্রিল ২০২০ থেকে ৩০জুন ২০২১। কৃষককে ধান, গম, দানা শষ্য, অর্থকরী ফসল, শাক সবজি ও কন্দাল ফসল চাষের ক্ষেত্রে এ প্রনোদনা দেয়া হবে। এতে ব্যাংক গুলো শতকরা ৫টাকা হারে সুদ-ক্ষতি পুনর্ভরন সুবিধা পাবে। এছাড়া মৎস্য ও প্রানী সম্পদ খাতেও চাষীর জন্য ৪ টাকা রেয়াতি সুদ হারে ঋন গ্রহনের সুযোগ রয়েছে।
অপরদিকে কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের সম্পৃক্ততায় ’কৃষি খাতে বিশেষ প্রনোদনামূলক পুন: অর্থায়ন স্কীম’ বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে-উপজেলা কৃষি অফিস বিশেষ প্রনোদনার এ স্কীম বাস্তবায়নে তফসিলী ব্যাংক সমূকে বহুল প্রচারের জন্য সহযোগীতা করবে। জন গুরুত্বপূর্ন স্থানে ঋন বিতরনের ব্যানার টানানো হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করবে। ঋন গ্রহনে আগ্রহী কৃষক প্রকৃত কৃষক কিনা তা সংশ্লিষ্ট ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সনাক্ত করবেন। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার সুপারিশের প্রেক্ষিতে কৃষি কর্মকর্তা প্রত্যয়ন প্রদান করবেন। এরপর ঋন গ্রহনকারী কৃষকদের তালিকা ব্যাংক সমূহ কৃষি অফিসে পাঠাবেন যাতে ঋন গ্রহনকারী কৃষকরা অফিস থেকে কৃষি সেবা পায়। কৃষি অফিস কৃষকদের চাষাবাদের ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করবেন। কৃষি অফিসের প্রতিনিধি ঋন প্রদানের ক্ষেত্রে কৃষি উপকরন সহায়তা কার্ডের ব্যবহার অথবা জাতীয় পরিচয় পত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রকৃত কৃষক ঋন পাচ্ছেন কিনা তা নিশ্চিত করবেন। কৃষক যাতে ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব খুলতে পারে এবং সে হিসাবের মাধ্যমে ঋন গ্রহন করতে পারে সে বিষয়ে কৃষক ও তফসিলী ব্যাংকের মধ্যে কৃষি বিভাগ সমন্বয় সাধন করবেন। কৃষক যাতে ঋন পেতে হয়রানীর স্বীকার না হয় এবং সহজে ঋন পায় কৃষি অফিস তা নিশ্চিত করবেন। ঋন গ্রহনের পর কৃষক শর্ত মোতাবেক ফসল বা প্রস্তাবিত কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছেন কিনা তা কৃষি বিভাগ তদারকি করবেন এবং তাদের যথাযথ পরামর্শ প্রদান করবেন। প্রতি মাসে তফসিলী ব্যাংক গুলো কি পরিমান প্রনোদনার এ ঋন বিতরন করছে সে মর্মে কৃষি বিভাগকে অবহিত করবেন। সে মোতাবেক কৃষি অফিস ঋন গ্রহন ও বিতরনের অগ্রগতি প্রতিবেদন যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে প্রেরন করবেন।
এদিকে কৃষিতে স্বনির্ভরতা অর্জনে দেশের এক ইঞ্চি চাষাবাদের জমিও যাতে অনাবাদী না থাকে সেজন্য সরকারের এ নির্দেশনার ছিটে ফোটারও দেখা মেলেনি বাস্তবে। শতকরা ৪টাকা হারের সরকারের এ ঋন নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কোন প্রচারনা নেই। মাঠ পর্যায়ের করোনা ও ঘূর্নিঝড় আম্পান ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে অধিকাংশ কৃষক সরকারের বিশাল পরিসরের এ প্রনোদনার ঋন সম্পর্কে এখনও অবগত নন। এমনকি সাধারন কৃষি ঋন পেতে উৎকোচ বিনিময়ে দালাল নির্ভর হয়ে ব্যাংকে না গেলে নানান রকম হয়রানীর স্বীকার হচ্ছেন তারা। ঋন পেতে জমির মূল দলিল, ওয়ারিশ সার্টিফিকেট, এসএ পর্চা, বিএস পর্চা, হাল দাখিলা, ট্যাক্স রশিদ সহ রাষ্ট্রায়াত্ত অন্য ব্যাংকে লোন নাই মর্মে প্রত্যয়ন চাওয়া হচ্ছে কৃষকদের কাছে। এতসব কাগজ সংগ্রহ করতে না পেরে অনেক কৃষক ঋন সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছে। কৃষি বিভাগের যথাযথ তদারকি না থাকার সুযোগে কৃষক না হয়েও অনেকে কৃষক সেজে ঋন সুবিধা নিচ্ছে। মোটা দাগে তফসিলী ব্যাংক গুলোর সাথে কৃষি বিভাগের কোন রকম সমন্বয় নেই। এছাড়া ঋন বিতরনের ক্ষেত্রে সরকারের নির্দেশনা না মেনেই ঋন বিতরন চলছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ঘুুরে দাড়ানো কিংবা ১ ইঞ্চি জমিও অনাবাদী না থাকার সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য ভেস্তে যেতে বসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কৃষি খাতের জন্য ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার প্রনোদনার আওতায় কলাপাড়ার রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংক সহ বেসরকারী তফসিলী ব্যাংক সমূহ শতকরা ৪টাকা হারে ঋন বিতরনের জন্য বরাদ্দ পেয়েছে। তন্মধ্যে কৃষি ব্যাংক কলাপাড়া শাখা ৮০ লক্ষ, মহিপুর শাখা ৪৫ লক্ষ, কুয়াকাটা শাখা ৪০ লক্ষ, সোনালী ব্যাংক কলাপাড়া বন্দর শাখা ৩০ লক্ষ, অগ্রনী ব্যাংক খেপুপাড়া শাখা ৫ লক্ষ টাকা, রুপালী ব্যাংক ১২ লক্ষ টাকা। এ বরাদ্দের বিপরীতে কৃষি ব্যাংক কলাপাড়া শাখা ইতোমধ্যে ১৪জনকে ৯ লক্ষ ৮৩ হাজার টাকা, মহিপুর শাখা ৪ লক্ষ ১৬ হাজার টাকা ৮ জনকে, কুয়াকাটা শাখা ১০ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা ১০ জনকে, সোনালী ব্যাংক কলাপাড়া বন্দর শাখা প্রায় ১৪ লক্ষ টাকা বিতরন করেছে ৬৬ জন কৃষকের মাঝে। অগ্রনী ব্যাংক ও রুপালী ব্যাংক শতকরা ৪টাকা সুদের কোন ঋন বিতরন করেনি।
এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থ বছর পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার কৃষকের মাঝে কৃষি ব্যাংক কলাপাড়া শাখার ২৬ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকা ঋন বিতরন রয়েছে। এরমধ্যে দীর্ঘদিনের ৪ কোটি টাকা খেলাপী ঋন রয়েছে। যা আদায়ে ২৮৬টি মামলা করা হয়েছে। তন্মধ্যে ২০টি ঋনের ৭ লক্ষ টাকা আদায় করা গেছে। মহিপুর শাখার এ পর্যন্ত আড়াই হাজার কৃষকের মাঝে ১২ কোটি ৩৮ লক্ষ ৭৬ হাজার টাকা ঋন বিতরন রয়েছে। এবছর নতুন করে ৯৮ জন কৃষককে ৬৩ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। ২ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা খেলাপী ঋন আছে। ১৩টি মামলা করা হয়েছে। ১টি খেলাপী ঋন ৬০ হাজার টাকা আদায় হয়েছে। কুয়াকাটা শাখা এ বছর ২৬৪জন কৃষকের মাঝে ২ কোটি ৫৬ লক্ষ ১০ হাজার টাকা কৃষি ঋন দিয়েছে। এ পর্যন্ত ৯ কোটি ৮৪ লক্ষ ২০ হাজার টাকা ১৫৫৭ জন কৃষকের মাঝে ঋন দেয়া আছে। এরমধ্যে খেলাপী ঋন রয়েছে ১৯ লক্ষ ৬৪ হাজার। ৮ টি মামলা করা হয়েছে। সোনালী ব্যাংক কলাপাড়া বন্দর শাখা ২০১৯-২০ অর্থ বছরে কৃষি ঋন বরাদ্দ পায় ১ কোটি ৭১ লক্ষ। বিতরন করে ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা ১১০ জনের মধ্যে। ৫৮৫০ জন ঋন গ্রহীতার খেলাপী ঋন রয়েছে ৭ কোটি ৬৭ লক্ষ টাকা । অগ্রনী ব্যাংক খেপুপাড়া শাখার ২৯০৩ জন কৃষকের এ যাবৎ ঋন রয়েছে ১২কোটি ১ লক্ষ ৬৩ হাজার ৫৪৪ টাকা। এরমধ্যে ৫৭৮ জনের খেলাপী ঋনের পরিমান ৪৭ লক্ষ ৪২ হাজার ৩৫১ টাকা। মামলা করা হয়েছে ১৭৬টি। ব্যাংকটি শতকরা ৪টাকা সুদের কোন ঋন বিতরন করেনি। এসব ব্যাংক গুলোর অগনিত কর্মকর্তা স্থানীয় এবং দীর্ঘদিন একই স্থানে বারবার চাকুরী করার সুযোগ পেয়ে নীতিমালা বহির্ভূত ভাবে ঋন বিতরন করায় কৃষি ঋন বিতরন ও আদায়ে এ হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংক গুলোতে দালাল প্রবনতা বেড়েছে।
তবে বেসরকারী ব্যাংক প্রিমিয়ার, মার্কেন্টাইল, ন্যাশনাল, পূবালী, শাহজালাল, ইসলামী, ব্র্যাক ব্যাংক সহ অপরাপর বেসরকারী ব্যাংক গুলো রাষ্ট্রের নির্দেশনার পরও কৃষি খাতের উন্নয়নে কৃষককে অদ্যবধি কোন ঋন বিতরন করেনি। সরকারের সুস্পষ্ট নির্দেশনার পরও এনিয়ে তাদের কোন আগ্রহ নেই। এ বিষয়ে ব্যাংক গুলোর কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করেও তাদের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
কৃষি বিভাগের প্রত্যয়ন ছাড়া শতকরা ৪টাকা হারের কৃষি ঋন বিতরন নিয়ে জানতে চাইলে কৃষি ব্যাংক, কলাপাড়া শাখার ব্যবস্থাপক মো: আনোয়ার হোসেন বলেন, কৃষি বিভাগের প্রত্যয়ন দেয়ার বিষয়টি তাদের জানা নেই। তাঁরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ঋন বিতরন করছেন। প্রায় একই বক্তব্য মহিপুর শাখার ব্যবস্থাপক বিএম রেফায়েত উল করিম ও কুয়াকাটা শাখার ব্যবস্থাপক রবীন চন্দ্র শীল’র।
সোনালী ব্যাংক কলাপাড়া বন্দর শাখার ব্যবস্থাপক নাজমুল আহসান এর বক্তব্য, উর্ধ্বতনদের অনুমতি ছাড়া এবিষয়ে কথা বলার কোন অধিকার নেই তাঁর। অগ্রনী ব্যাংক খেপুপাড়া শাখার ব্যবস্থাপক মো: আলআমিন বলেন, ’ব্যাংকের কোন তথ্য জানতে হলে আগে উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসতে হবে। নতুবা কোন তথ্য দেয়া যাবেনা। তবে ৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ পেলেও শতকরা ৪টাকা সুদের ঋনের টাকা এখনও কোন কৃষককে দেয়া হয়নি।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল মান্নান বলেন, ’উপকূলীয় এলাকার কৃষি উৎপাদনকে সচল রাখতে ৪টাকা সুদের প্রনোদনা দিয়েছে সরকার। যা বিতরনে অবশ্যই কৃষি বিভাগের প্রত্যয়ন থাকতে হবে। এসংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রতি মাসে উর্ধ্বতনদের পাঠানোর নির্দেশনা রয়েছে।’ তিঁনি আরও বলেন, ’কৃষিকে সচল রাখতে পানি ব্যবস্থাপনার জন্য স্লুইস গুলো কৃষকের স্বার্থে ব্যবহৃত হতে হবে। এ উপজেলায় প্রায় ৩০০ স্লুইস কৃষকের স্বার্থ ভুলুন্ঠিত করে প্রভাবশালীদের মাছ ধরার স্বার্থে ব্যবহার হচ্ছে।
কলাপাড়া ইউএনও আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক বলেন, ’সরকারের এ প্রনোদনা কৃষিকে আরও সচল এবং কৃষককে চাষাবাদে আরও উদ্যমী করে তোলার জন্য। যাতে দেশ খাদ্যে স¦নির্ভরতা অর্জন করতে পারে। সরকারের নির্দেশনা বহির্ভূত ভাবে ঋন বিতরন করার সুযোগ নেই। এলক্ষে জেলা, উপজেলায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের সাথে সভা আহবান করা হচ্ছে। স্থানীয় ব্যাংক গুলোকে দু’এক দিনে চিঠি দেয়া হবে।
Leave a Reply